নিজস্ব প্রতিনিধি: তিন মাসের জন্য গঠিত সাতক্ষীরা জেলা যুবলীগের আহবায়ক কমিটি ৬ বছর পার করেছে। দীর্ঘদিন ধরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় জেলা যুবলীগের নেতৃত্বে আসতে পারছেন না নবীনরা। বঞ্চিতরা বলছেন, এতে যেমন সংগঠনের এই শাখা গতি হারিয়ে ফেলছে, তেমনি দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়ায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন অনেক নেতাকর্মীই। অথচ বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের দিনগুলোতে সাতক্ষীরার রাজপথ মিছিল-শ্লোগানে প্রকম্পিত করা আওয়ামী যুবলীগ প্রায় দেড় যুগ ধরে চলছে পুর্নাঙ্গ কমিটি ছাড়া। দলীয় অঙ্গীকার পূরণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচীতে মাঠে সবার আগে সক্রিয় থেকে হামলা,মামলা, অপহরণ এমনকি হত্যাকান্ডের স্বীকার হয়েছেন। অথচ বিভিন্ন সময়ে নিজেদের স্বার্থে আওয়ামী রাজনীতির সবচেয়ে সক্রিয় এ অঙ্গ সংগঠন নিয়ে ভাঙ্গা-গড়ার খেলা খেলেছেন ক্ষমতায় থাকা স্থানীয় নেতারা।
ক্ষমতাসীন দলের যুবসংগঠনটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলা যুবলীগের আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয় ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর। ২৯ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির আহবায়ক করা হয় সাবেক সভাপতি আব্দুল মান্নানকে। যুগ্ম-আহবায়ক মনোনীত হন জহিরুল ইসলাম নান্টু। তিন মাসের মধ্যে সম্মেলন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার কথা থাকলেও গত ৬ বছরে তা করতে পারেননি তারা। এরই মধ্যে পরিবর্তন এসেছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে। এছাড়া গত ৩ আগস্ট সংগঠন বিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগে আহবায়ক আব্দুল মান্নানকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। সম্প্রতি জেলা যুবলীগের কমিটি গঠন নিয়ে ফের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এরপর থেকে যুবলীগের নতুন কমিটি নিয়ে আশার আলো দেখছেন জেলার সাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতারা। ইতোমধ্যে অনেক নেতারা নতুনকরে কার্যক্রম শুরু করেছেন। তৃণমূল কর্মীদের সমর্থন পাওয়ার জন্য মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন কেউ কেউ। ইতোমধ্যে নেতাকর্মীরা তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করেছেন। তাই নেতাকর্মীরা মনে করছেন, নতুন কমিটি গঠন হলে সংগঠন আরও চাঙ্গা হবে।
খোদ নেতাদেরই অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করেছেন, ‘মেয়াদ পেরোনো কমিটির নিয়ন্ত্রক নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতা, অগণতান্ত্রিক ও নেতিবাচক কর্মকাÐে তারা ক্ষুব্ধ। আহবায়ক কমিটি গঠন হওয়ার পর আজ পর্যন্ত ককেটি উপজেলা ছাড়া ও অন্য কোন ইউনিটে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়নি। অর্থের বিনিময়ে একই উপজেলা ও ইউনিয়নে একাধিক কমিটি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। যে কারণে নেতৃত্ব বিকাশ এবং সংগঠনে গতিশীলতা তৈরি হয়নি।’ অবিলম্বে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের অনুরোধ জানান তারা। নেতা কর্মীরা বলেন, এর আগে একাধিকবার কমিটি গঠন নিয়ে গুঞ্জন উঠলেও শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। ফলে ৬বছর ধরে আহবায়ক কমিটি দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে জেলা যুবলীগ।
যুবলীগের তৃণমুলের কর্মীরা জানান, নতুন কমিটিতে এবার সভাপতি পদে আলোচনায় রয়েছেন ক্লিন ইমেজের নেতা হিসেবে পরিচিত জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বর্তমান যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য কাজী আকতার হোসেন, বর্তমান আহবায়ক আব্দুল মান্নান, যুগ্ম আহবায়ক জহিরুল ইসলাম নান্টু, মীর মাহিতুল আলম মাহী। সাধারণ সম্পাদক পদে, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তানভির হোসেন সুজন, সদর উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক মিজানুর রহমান, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তামিম আহম্মেদ সোহাগ, ওয়াহেদ পারভেজ, মনোয়ার হোসেন অনু, জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান বাবুর নাম শোনা যাচ্ছে। এছাড়া এখনই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরো কয়েকজন হেভিওয়েট সাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা জানান, সময় এলেই নাম প্রকাশ করে কাজ শুরু করবেন তারা।
সংগঠন সূত্রে জানা যায়, যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরির সাথে সুসম্পর্ক থাকায় আব্দুল মান্নান ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত জেলা যুবলীগের সভাপতি ও ২০১৪ সাল থেকে ৩ আগস্ট বহিষ্কারের আগ পর্যন্ত যুবলীগের আহŸায়কের পদে ছিলেন। যদিও এর আগেও তিনি সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কার হন। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে যুবলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকায় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তার। কিন্তু তিন মাসের আহবায়ক কমিটি নিয়ে ৭বছর ধরে সম্মেলন করতে না পারার ব্যর্থতাও তিনি এড়াতে পারেন না বলে মনে করেন পদ প্রত্যাশীরা।
সভাপতি পদে এবার সবচেয়ে বেশি আলোচনায় কাজী আক্তার হোসেন। তিনি ১৯৯০ সালে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, সহ সভাপতি, ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর ২০০৩ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর একটানা ২০১০ সাল পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ছাড়ার পর যুবলীগের কর্মকান্ডে নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন তিনি।
সাধারণ সম্পাদক পদে এখন পর্যন্ত যারা প্রার্থী রয়েছেন বর্তমান তারা সবাই সাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মী জেলার ছাত্র ও যুব সমাজের কাছে তারা সবাই পরিচিত মুখ।
কমিটি গঠনের বিষয়ে জেলা যুবলীগের সদস্য কাজী আক্তার হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন হয়ে গেলো নতুন কমিটি হচ্ছে না। আহবায়ক কমিটিতে চলছে ৭ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে অনেকে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, অনেকে মারাও গেছে, আবার অনেকে অন্য কমিটিতে ঢুকে গেছে। । দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ার ফলে অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের বিকাশ ও গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবে হতাশা প্রকাশ করছেন দুঃসময়ের ত্যাগী অনেক কর্মী-সমর্থক। এ সুযোগে সংগঠনে অনুপ্রবেশ করছে এক শ্রেণির সুবিধাবাদী হাইব্রিড ও বিভিন্ন দলত্যাগী কর্মীরা। তাদের দাপটে কোণঠাসা দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতৃত্ব। আমি মনে করি, সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি হওয়া উচিত। দলের স্বার্থে এখন নতুন নেতৃত্ব দরকার।
সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী তামিম আহম্মেদ সোহাগ বলেন, সুন্দর রাজনীতির জন্য চাই নতুন নেতৃত্ব। সম্মেলনের মাধ্যমে মেধাবীরা আসুক, যারা সংগঠনকে গতিশীল করবে। সম্মেলন হলে এই সময়ের যোগ্য লোকরাই কমিটিতে আসবে। এক্ষেত্রে আমাকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় তবে আমি সঠিকভাবে পালন করব।
সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী পৌর যুবলীগের আহবায়ক মনোয়ার হোসেন অনু বলেন, আমি দীর্ঘদিন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতৃত্বে রয়েছি। এই কয়েক বছরে আমি চেষ্টা করছি যুবলীগ যেন কোনো দুর্নামের ভাগীদার না হয়। নেতারা যদি আমাকে যুবলীগের দায়িত্ব দেন, তবে আমি সঠিকভাবে পালন করব।
সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী আমিনুর রহমান বাবু বলেন, আমি জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভপতির দায়িত্ব পালন করেছি। জেলা যুবলীগকে গতিশীল করতে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে দাবি করব দ্রæত সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি দেয়া হোক। আমি ছোট থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি। জনপ্রতিনিধিদের সমর্থনে নির্বাচিত হয়ে বর্তমানে জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছি। আমি যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেলে জেলার যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করব।
এদিকে কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক শীর্ষ নেতার খুব কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত যুবলীগের পদ প্রত্যাশী ওয়াহেদ পারভেজ বলেন, জেলার যুবলীগ কর্মীরা নতুন নেতৃত্ব চাই। আমি এ কারণে প্রার্থী হচ্ছি। তবে আমি কি পদে থাকব তা এখনই বলতে চাচ্ছি না। করোনা মহামারিতে যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে আমি যুবলীগের ব্যানারে বিভিন্ন কার্যক্রম করেছি। যা জেলাব্যাপি প্রশংসিত হয়েছে। যোগ্য নেতারাই কমিটিতে আসবে। আমরা এখন কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছি।
জেলা যুবলীগের বর্তমান যুগ্ম আহবায়ক জহিরুল ইসলাম নান্টু বলেন, বহিষ্কৃত আহবায়ক আব্দুল মান্নানের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়মের কারণে এতদিন জেলা যুবলীগের সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। তিনি বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নে একাধিক কমিটি করে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি করে রেখেছেন। উপজেলা যুবলীগের বর্তমান কমিটিতে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকায়, কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় তৃণমূল কর্মীরা দ্বিধান্বিত। সংগঠন বিরোধী কার্যক্রমের অভিযোগে বর্তমান আহবায়ক আহবায়ক আব্দুল মান্নান বহিষ্কার হওয়ার পর, যুবলীগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য কেন্দ্র থেকে আমাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমি এখন সকল ইউনিটের সমস্যা চিহ্নিত করে কেন্দ্রকে অবহিত করছি। সম্মেলনের বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত জানাবেন। আমি এই মুহ‚র্তে নিজেকে সভাপতি প্রার্থী ঘোষণা করছি না। তবে কর্মীরা চাইলে সময় সবকিছু বলে দেবে।